Qshop App

প্রশ্নঃ সাধারণত আমরা মা-বাবা, শিক্ষক ও পীর-মুর্শেদকে কদমবুচি করে থাকে। কিন্তু অনেকেই বর্তমানে কদমবুচির বিপক্ষে কথা বলে। তাদের যুক্তি হল আল্লাহ্‌ ব্যতীত কারো সমীপে মাথা নত করা যায় না, কদমবুচি করার সময় মাথা নিচু হয়ে যায়, তাই তা শির্‌কে পরিণত হয়। আমার প্রশ্ন হল- কদমবুচি করার সময় তো স্বাভাবিকভাবে মাথা নিচু হয়ে যায়, তাই বলে কি তা শির্‌ক হবে? এ ব্যাপারে কোরআন্‌ ও সুন্নাহর আলোকে বুঝিয়ে বললে ধন্য হব।

উত্তরঃ প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থ ‘‘মিশকাত শরীফ’’-এর بَابُ الْمُصَافَحَۃٌ وَالْمُعَانَقَۃٌ অধ্যায়ের اَلْفَصْلُ الثَّانِیُّ তে বর্ণিত আছে যে,

وَعَنْ ذِرَاعٍ وَکَانَ مَنْ وَفْدِ عَبْدِ الْقَیْسِ قَالَ لَمَّا قَدِمْنَا الْمَدِیْنَۃَ فَجَعْلْنَا نَتَبَادَرُ مِنْ رَّوَاحِلِنَا فَنُقَبِّلَ یَدَ رَّسُوْلَ اللّٰہِ ﷺ وَرِجْلَہٗ

অর্থাৎ, ‘‘হযরত যিরাজ্ঞ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, যিনি আবদুল কায়্‌সের প্রতিনিধিভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, যখন আমরা মদীনা শরীফে আসলাম তখন আমরা নিজ নিজ বাহন থেকে তাড়াতাড়ি অবতরণ করতে লাগলাম। অতঃপর আমরা হুজূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে ও পায়ে চুমু দিয়েছিলাম।’’ [মেশকাত শরীফ] এখানে উল্লেখ্য, কাউকে আল্লাহ্‌ মনে করে ইবাদতের নিয়্যতে মাথা নত করা হলে তা শির্‌ক ও হারাম হবে। কিন্তু কোন সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান করার জন্য তার পায়ে চুমু দেওয়ার কারণে মাথানত করাকে শির্‌ক বলা নিছক মূর্খতা ও বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, পা চুম্বন করা মাথা নোয়ানো ছাড়া সম্ভবপর নয়। পায়ে চুম্বন করা হলে অবশ্যই মাথা নিচু করতে হয়। এখানে পায়ে চুম্বন করার সময় মুসলমান ওই ব্যক্তিকে কখনো উপাস্য বা আল্লাহ্ মনে করেন্‌ না। শুধুমাত্র সম্মানের জন্যই পায়ে চুম্বন করা হয়। এ প্রকার চুম্বন সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত, বিধায় তা জায়েয। ‘মাথা নত’ হওয়ার কারণে শির্‌ক বলাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, এমন হাজারো কাজ-কর্ম আছে যা মাথা নত করা ব্যতীত সম্পাদন করা যায় না। যদি ‘মাথা নত’ করা শির্‌ক হয়, তবে মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে যাবে। মূলতঃ মানুষের অন্তরের নিয়্যতই এখানে বিবেচ্য। সম্মানিত ব্যক্তি ও বুযর্গানে দ্বীনের হাত-পা চুম্বন করার বৈধতার উপর ইমাম বদরুদ্দীন আইনী আল্‌ হানাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘উমদাতুল ক্বারী’তে এবং ইমাম ইবনে হাজার আস্‌ক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাত্‌হুল বারী’তে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

 ১নং হাদীসঃ  

عن زارع وكان فى وفد عبد القيس قال لما قدمنا المدينة وجعلنا نتبادر من رواحلنا فنقبل يد رسول الله صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থাৎ, হযরত যারেঈ রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু যিনি আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা যখন মদিনা শরীফে আগমন করলাম তখন আমাদের বাহন হতে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম এবং রসূল-এ করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হস্ত মোবারক ও পা মোবারক চুম্বন করলাম।   সূত্র: আবূ দাউদ শরীফের সূত্রে মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃষ্ঠা: ৪০২   
 ২ নং হাদীসঃ  

عن صفوان بن عسال ان قوما من اليهود قبلوا يد النبى صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থাৎ, হযরত ছাফওয়ান বিন আসলাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই ইয়াহুদীদের একটি গোত্র হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হাত ও পা মোবারক চুম্বন করে।   সূত্র: ইবনে মাজাহ পৃ: ২৯২   
 ৩ নং হাদীসঃ  

হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
سأل أعربى النبى صلى الله عليه وسلم أية فقال له قل لتلك الشجرة رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعوك فقال فمالت الشجرة عن يمينها وشمالها وبين يديها وخلفها فقطعت عروقها ثم جاءت يتخذ الارض تجر عروقها مغبرة حتى وقعت بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم ثم قال له السلام عليك يا رسول الله قال الاعرابى مرها فلترجع الى منبتها فرجعت فدلت عروقها فاستوت فقال الاعربى ائذن لى اسجد لك قال لو أمرت احدا ان يسجد لاحد لامرت المرأة ان تسجد لزوجها قال فأذن لى ان اقبل يديك ورجليك فاذن له 
অর্থাৎ, একজন বেদুঈন হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র কাছে মুজিযা দেখতে চাইল, হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেদুঈনকে এরশাদ করলেন ওই বৃক্ষটাকে বলো আল্লাহর রসূল তোমাকে ডাকছেন, সে যখন বললো বৃক্ষ তার ডানে-বামে, সম্মুখে পেছনে ঝুকল তখন ওটার শিকড়গুলো ভেঙ্গে গেল। তারপর তা মাটি খোদাই করে শিকড়গুলো টেনে বালি উড়িয়ে হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সম্মুখে এসে দাড়াল এবং বলল আস্‌সালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ! বেদুঈন বললো “আপনি তাকে আদেশ করুন যেন এটা ওখানে (উৎপত্তিস্থল) ফিরে যায়” তাঁর নির্দেশে ওটা ফিরে গেল এবং তার শেকড়গুলোর উপর গিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। বেদুঈন বললো “আমাকে অনুমতি দিন আমি আপনাকে সিজদা করবো” তিনি এরশাদ করলেন, “যদি কাউকে সাজদাহ করার হুকুম দিতাম তাহলে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম সে যেন তার স্বামীকে সাজদাহ করে।” বেদুঈন লোকটি আরজ করলো “হুযুর তাহলে আমাকে আপনার হস্ত ও পদদ্বয় মোবারক চুম্বন করার অনুমতি দিন” তিনি (নবীজী দঃ) তাকে অনুমতি প্রদান করলেন।   সূত্রঃ শিফা শরীফ, দালাইলুন্নুবয়্যাহ আবু না’ঈম, পৃষ্ঠা- ৩৩২।   
 ৪ নং হাদীসঃ  

روى عن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقبل فاطمة ويقول اجد منها ريح الجنة وقبل ابو بكر رأس عائشة وقال النبى صلى الله عليه وسلم من قبل رجل امه فكان قبل عنبة الجنة
অর্থাৎ, হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, হযরত ফাতেমা (নবীজীর স্নেহের কন্যা) রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহাকে চুমু খেতেন আর তিনি বলতেন আমি ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছ থেকে বেহেশতের সুঘ্রান পাচ্ছি। হয়রত আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার মাথা মোবারক এ চুমু খেয়েছেন। আর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি তার মায়ের পা চুম্বন করবে সে যেন বেহেশতের চৌকট চুমু খেল।   সূত্র: মাবসুত লিস সারাখছি, খন্ড-১০, পৃষ্ঠা: ১৪৯।   
 ৫ নং হাদীসঃ  

عن ذكوان عن صهيب قال رايت عليا يقبل يد العباس ورجله
অর্থাৎ হযরত যাকওয়ান রদ্বিয়াল্লাহু হযরত ছুহাইব সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে (স্বীয় চাচা) হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহুর হাত ও পা যুগল চুম্বন করতে দেখেছি।   সূত্রঃ মিশকাত শরীফ।   
 বুখারী শরীফে মুকাদ্দামায় আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন-  
قال جاء مسلم بن الحجاج الى البخارى فقبل بين عينيه وقال دعنى اقبل رجليك يا استاذ الاستاذين ويا سيدالمحدثين ويا طبيب الحديث فى علله –
অর্থাৎ,- একদা হযরত ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি হযরত ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষাৎ পানে ধন্য হওয়ার জন্য আগমন করে ইমাম বুখারীর উভয় চোখের মাঝখানে চুম্বন করলেন, অত:পর তিনি ইমাম বুখারীকে সম্বোধন করে বললেন, হে শিক্ষককূল শিরমণি! মূহাদ্দিসগণের সম্রাট ও হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কারনসমূহ অনুসন্ধানে ডাক্তারের ভূমিকা পালনকারী সম্মানিত ও পবিত্র সত্ত্বা, আমাকে একটু মেহেরবানী করে আপনার পদযুগল চুম্বন করে ধন্য হওয়ার সুযোগ দিন।   সূত্র: মুকাদ্দামাতু সহিহীল বুখারী, পৃষ্ঠা- ৩।  

ওয়াযি ইবনে আমির (রাঃ) বলেন, আমি একদা রাসূলে করীম (ﷺ) -এর খেদমতে গিয়ে হাজির হইলাম । আমাকে বলে হইল, ইনিই হইতেছেন আল্লাহ্‌র রাসূল । আমরা তখন তাঁহার হস্তদ্বয় ও পদদ্বয় ধরিয়া চুমু খাইলাম । [দলিল- তিরমিযী শরীফঃ- ২৭৩৩, সুনানু ইবনে মাজাহঃ- ৩৭০৫, রিয়াদূস সালেহীনঃ- ৮৮৯ । তফসীর ইবনে কাসীরঃ- ৬৪৬পৃষ্ঠা/৩য় খন্ড । হাদীসঃ- আলা-আদাবুল মুফরাদ- ৯৮৭, লেখকঃ- ইমাম বুখারী (রা) ] [২] সুহায়ব বলেনঃ- আমি হযরত আলী (রাঃ)-কে দেখিয়াছি তিনি হযরত আব্বাসের হস্ত ও পদদ্বয়ে চুম্বন প্রদান করিতেছেন।[দলিল- তিরমিযী শরীফঃ- ২৭৩৩, সুনানু ইবনে মাজাহঃ- ৩৭০৫, রিয়াদূস সালেহীনঃ- ৮৮৯, তফসীর ইবনে কাসীরঃ- ৬৪৬পৃষ্ঠা/৩য় খন্ড, হাদীসঃ- আলা-আদাবুল মুফরাদ- ৯৮৮, লেখকঃ- ইমাম বুখারী (রা)] এ হাদিস দুইটি হাসান সহীহ। জাল-যঈফ বলা অন্যায় হবে। আর যদি পা ধরে চুম্বন করা জায়েজ হয় তাহলে সামান্য পা ছুয়ে সালাম করাতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। এছাড়াও ফতোয়ায় পাওয়া যায়- শরীফের স্তম্ভগুলোর চুম্বন থেকে কতেক উলামায়ে কিরাম বুযুর্গাণে দ্বীন ও অন্যান্যদের পবিত্র বস্তুসমূহ চুম্বন ও সালাম দেওয়ার বৈধতা প্রমাণ করেন। ইমাম আহমদ ইব্নে হাম্বল (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে তার কাছে কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল- হুযূর আলাইহিস সাললামের মিম্বর বা পবিত্র কবর মুবারকে চুমু দেয়া বা সালাম দেওয়াটা কেমন? তিনি এর উত্তরে বলেছিলেন, কোন ক্ষতি নেই। মক্কা শরীফের শাফেঈ উলামায়ে কিরামের অন্যতম হযরত ইবনে আবিস সিন্ফ ইয়ামানী থেকে বর্ণিত আছে- কুরআন করীম ও হাদীস শরীফের পাতাসমূহ এবং বুযুর্গানে দ্বীনের কবরসমূহ চুমু দেয়া এবং সালাম করা জায়েয। [দলিলঃ আল্লামা ইবনে হাজরের রচিত শরহে বুখারীর ষষ্ঠ পারার ১১৫ পৃষ্ঠা] এ ফতোয়া থেকে কদমবুচিকেও জায়েজ বলা যায়। এতে শিরক হবে না।

সুতরাং, সহীহ হাদীস শরীফ, সাহাবায়ে কেরামের আমল ও বিশ্ব বরেন্য ওলামায়ে কেরাম-এর অভিমত ও আমল দ্বারা প্রমাণিত হল হাত ও কদমবুচি শুধু জায়েযই নয়’ বরং সাহবায়ে আজমাঈনদের সুন্নাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *